কুরবানিতে করণীয় ও বিশেষ আমল


ঈদুল আজহা ও কুরবানি। ইসলামের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ও আত্মত্যাগের অনন্য ইবাদত। আত্মত্যাগ ও মানবতার বার্তা নিয়ে প্রতিবছরই মুসলিম উম্মাহর সামনে হাজির হয় এ উৎসব। এ বছর ১৪৪২ হিজরির জিলহজ মাসের ১০ তারিখ (২১ জুলাই) মহাসমারোহে পালিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা ও কুরবানি।

আরবি করব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দ থেকে উর্দূ ও ফার্সিতে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ দাঁড়ায়-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরবান হল, প্রত্যেক সেই বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর সেখান থেকেই ফারসী বা উর্দু-বাংলাতে গৃহীত হয়েছে ‘কুরবানি’ শব্দটি।

মুসলমানের জন্য কুরবানি করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
অর্থ: ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কুরবানি কর।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ২)

ঈদের দিনের বিশেষ আমল

ঈদের দিন মুমিন মুসলমানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। নিজেকে পরিপাটি ও সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়ায় এসব আমল পালন করতে হয়। তাহলো:

মিসওয়াক ও গোসল করা

মিসওয়াক ও গোসল স্বাভাবিক অবস্থায় সুন্নাত। ঈদের দিন এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, ঈদের নামাজে বহু মানুষের সমাগম হয়। সেখানে পূর্ণ পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে উপস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাদিসে এসেছে:

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন গোসল করতেন।’ (নাসবুর রায়াহ)

উত্তম পোশাক পরিধান

ঈদের দিন নিজের পোশাকাদির মধ্যে থেকে উত্তম ও সুন্দর পোশাক পরা সুন্নত। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক ঈদে ডোরাকাটা কাপড় পরিধান করতেন।' (বায়হাকি)

নামাজের আগে কিছু না খাওয়া

ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের উদ্দেশ্যে ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু মিষ্টান্ন খেয়ে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু ঈদুল আজহার দিন এমনটি মুস্তাহাব নয়; বরং কুরবানি হয়ে যাওয়ার পর দিনের প্রথম খাবার হিসেবে কুরবানির গোশত খাওয়া মুস্তাহাব।

ফেরার পথে রাস্তা পরিবর্তন

ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক রাস্তা এবং ঈদের নামাজ শেষ করে অন্য রাস্তায় ঘরে ফেরা মুস্তাহাব। হাদিসে এসেছে-
হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে) রাস্তা বদল করতেন।' (বুখারি)

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া-আসা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন। তাঁর সামনে একটি বর্শা বহন করে নেয়া হতো এবং সেটা নামাজের সময় তাঁর সামনে ‘সুতরা’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো।' (বায়হাকি)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যেতেন। ঈদগাহ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন।'

ঈদগাহে যাওয়া-আসার পথে তাকবির বলা

ঈদগাহে যাওয়ার পথে উঁচু আওয়াজের তাকবির বলা সুন্নত। হাদিসে এসেছে-
হজরত নাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয় ঈদের নামাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হতেন। ঈদগাহে পৌছা পর্যন্ত (রাস্তায়) তাকবির বলতেন। ঈদগাহে পৌছেও ইমাম নামাজ আরম্ভ করার আগ পর্যন্ত তিনি তাকবির বলতেন।' (দারাকুতনি)

অন্য বর্ণনায়, হজরত আবু আব্দুর রহমান সুলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আজহায় অনেক বেশি তাকবির বলতেন।' (মুসতাদরেকে হাকেম)

তাকবির

اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَ اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر وَ للهِ الْحَمْد
উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
অর্থ: ’আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।’

শিশুদের ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া

ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় বড়রা ছোটদের সঙ্গে নিয়ে যাবে। এটা মুস্তাহাব আমল। হাদিসে এসেছে:

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ঈদের দিন (ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হতেন। ফজল ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ, আব্বাস, আলি, জাফর, হাসান, হোসাইন, উসামা ইবনে যায়েদ, যায়েদ ইবনে হারেসা ও উম্মে আয়মানের ছেলে আয়মানকে সঙ্গে নিয়ে। উঁচু আওয়াজে তাকবির বলতে বলতে কামারদের রাস্তা ধরে তিনি ঈদগাহে যেতেন এবং নামাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাড়ি আসতেন মুচিদের রাস্তা দিয়ে।’ (ইবনে খুযায়মা)

ঈদগাহে নামাজ আদায়

ঈদের দিন ঈদগাহে নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্বাদা। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে যেতেন।’ (বুখারি)

মসজিদে ঈদের নামাজ

যদি বৃষ্টিপাত হয় অথবা বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা থাকে তবে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া বৈধ। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একবার ঈদের দিন বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন।’ (আবু দাউদ)

ঈদের দিন কবর জিয়ারত

আনন্দ ও খুশির দিন হলো ঈদের দিন। অনেক সময় খুশিতে মানুষ আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কবর জিয়ারত মানুষকে আখেরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে ঈদের দিন কবর জিয়ারত করে উত্তম।

কুরবানির হুকুম

অনেক ইসলামিক স্কলারদের মতে, কুরবানি করা সুন্নাত। দলিল হিসেবে হাদিসের বর্ণনা হলো-
হজরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা জিলহজের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন চুল, নখ ইত্যাদি কাটা বন্ধ রাখে।’ (মুসলিম)
এ হাদিস ইঙ্গিত করে যে, কুরবানি মানুষের ইচ্চাধীন। ইচ্ছা হলে করবে, না হলে করবে না।

তবে অধিকাংশ হানাফি আলেমদের মতে কুরবানি ওয়াজিব। এ দাবির প্রথম প্রমাণ হচ্ছে কুরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি, সুতরাং আপনি আপনার রবের জন্য নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ১-২)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যাক্তি কুরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে-কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

কুরবানি আদায়ের সময়

ঈদের নামাজের আগে কুরবানি করা জায়েজ নয়। যদি কেউ ঈদের নামাজের আগে কুরবানির উদ্দেশ্যে কেনা পশু জবেহ করে তবে তা শুধু জবেহ হিসেবে পরিগণিত হবে। কেননা কুরবানি ঈদের নামাজের পরে আদায় করতে হয়।

কুরবানির নেসাব

কুরবানির দিনগুলোতে যদি কারো কাছে সাড়ে সাত তোলা/ভরি সোনা, অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা/ভরি রূপা, কিংবা সমমূল্যের কোনো নগদ অর্থ, বানিজ্যিক পণ্য, অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্তি জিনিসপত্র থাকে, তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়। এটাই কুরবানির নেসাব। (বাদায়েউস সানাঈ)

সাদকাতুল ফিতর ও জাকাতের নেসাবও একই। অর্থাৎ উল্লেখিত পরিমাণ সম্পদ থাকলে সদকাতুল ফিতর এবং জাকাতও ওয়াজিব হয়। তবে জাকাতের জন্য অতিরিক্ত দুটি শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হচ্ছে, সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া। আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, সেই সম্পদের ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।

কুরবানি আদায় হওয়ার শর্ত

যে বা যারা কুরবানি করবে, তাদের কুরবানি আদায় বিশুদ্ধ হওয়ার জন্যও ছয়টি শর্ত রয়েছে। যথা:
  1. নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া। একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কুরবানি করা। যদি কেউ অন্যকে দেখানোর উদ্দেশ্যে, কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার উদ্দেশ্যে অথবা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানি করে, তাহলে তার কুরবানি সহিহ হবে না।
  2. আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো নিয়ত আছে, এমন ব্যাক্তিকে কুরবানির সঙ্গে শরিক না করা। শরিক কুরবানির ক্ষেত্রে কোনো একজনের নিয়তে সমস্যা থাকলে সবার কুরবানি নষ্ট হয়ে যাবে।
  3. পশু জবাইয়ের সময় কুরবানির নিয়ত করা।
  4. কুরবানিদাতা ছাড়া অন্য কেউ পশু জবাই করলে কুরবানি দাতার অনুমতি থাকা। স্পষ্ট মৌখিক অনুমতি না থাকলেও কমপক্ষে অনুমতির ইঙ্গিত থাকা।
  5. কুরবানির পশু শরিয়তে গ্রহণযোগ্য ও দোষমুক্ত হওয়া। সুতরাং শরিয়ত অনুমোদন করে না, অথবা শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষযুক্ত পশু কুরবানি করলে সেই কুরবানি সহীহ হবে না।
  6. কুরবানি দাতা জবাইয়ের সময় নির্দিষ্ট পশুর মালিক হওয়া। কেউ যদি অন্যের পশু কুরবানির নিয়তে জবাই করে এবং সে যদি খুব কাছের মানুষও হয়, তবুও কুরবানি সহীহ হবে না।

কুরবানির পশুর বয়স

এক হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুরবানিতে তোমরা শুধু পরিপূর্ণ বয়সের পশু জবাই কর। তবে যদি পূর্ণ বয়সের পশু যোগাড় করতে তোমাদের কষ্ট হয়, তাহলে ছয় মাস বয়সের দুম্বা জবাই কর।’ (আবু দাউদ)

হাদিসে ‘মুসিন্নাহ’ পশু জবেহ করার কথা বলা হয়। মুসিন্নাহ বলা হয় ঐ পশুকে, যে পশুর দাঁত উঠেছে। ফোকাহায়ে কেরাম কুরবানির পশু উপযুক্ত হওয়ার জন্য বয়সের একটি সীমা বর্ণনা করে দিয়েছেন। তাহলো:
  • উট: ৫ বছর
  • গরু/মহিষ: ২ বছর
  • ছাগল/ভেড়া/দুম্বা: ১ বছর
(দুররুল মুখতার)